হুয়াকাচিনা: মরুভূমির মাঝে এক টুকরো স্বর্গ - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Tuesday, 1 August 2023

হুয়াকাচিনা: মরুভূমির মাঝে এক টুকরো স্বর্গ

 


হুয়াকাচিনা: মরুভূমির মাঝে এক টুকরো স্বর্গ 



প্রেসকার্ড নিউজ ওয়ার্ল্ড ডেস্ক, ০১ আগস্ট: মরীচিকা সম্পর্কে ধারণা আছে নিশ্চয়ই। মরুভূমির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আপনার শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করবে আর সে সময় হয় তো দেখতে পাবেন সামনে জলের স্রোত বয়ে চলেছে। আপনি সুনিশ্চিত ঠাণ্ডা জলের আশায় খানিক এগিয়ে যাবেন, কিন্তু কিছু দূর গিয়ে মনে হবে আপনার হাঁটার সঙ্গে জলের স্রোতও কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছে। এভাবে অনেকক্ষণ হাঁটার পর শেষ পর্যন্ত আপনি আর সেই জলের উ্ৎসের খোঁজ পাবেন না। মনে হবে যেন আপনাকে প্রতারিত করা হয়েছে। পূর্ন অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের জন্য এমনটা হয়ে থাকে। যেটা একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হলে আপনার ভালো মতো জানার কথা। 



কিন্তু যদি এমন হয়, যে আপনি জলের স্রোত দেখতে পেলেন, সেই অনুযায়ী এগিয়েও গেলেন এবং দেখলেন আসলেই জলের স্রোত সেখানেই। বিজ্ঞানকে ভুল প্রমাণ করার উপাদান পেয়ে খুশী হয়ে যেতে পারেন হয় তো! পেরুর মরুভূমিতে গিয়ে আপনি মরীচিকার বদলে বাস্তবেই এমন কিছুর সন্ধান পেতে পারেন, যেটা দেখলে আপনার চোখ কপালে উঠবে। পেরুর নাম শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে উঠে ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন মাচুপিচুর কথা। ১৯১১ সালে আমেরিকান ইতিহাসবিদ হিরমবিল হামের আবিষ্কার করার আগে পর্যন্ত আনগিস পর্বতমালার ওপর অবস্থিত এই স্থাপত্যের কথা পৃথিবীবাসীর কাছে অজানা ছিল। শুধু মাচুপিচু নয় রংধনু পাহাড়, নাচকালাইনও দেখার জন্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক ভীর জমান লাতিন আমেরিকার এই দেশে। 



সেই হিসেবে হুয়াকাচিনা প্রাক প্রদীপের আলোয় থাকা কোনও স্বল্প পরিচিত ঐতিহাসিক গুরুত্বহীন স্থান। মরুভূমির মাঝখানে চমৎকার একটি গ্ৰাম অথচ এর কোনও পরিচিতি নেই। এসব পর্যবেক্ষণ করলে বিস্ময় জাগে। মরুভূমি প্রেমী মানুষরা পৃথিবীর যে সকল স্থানে অন্তত জীবনে একবার হলেও ভ্রমণ করতে চান, সেই স্থানগুলোর তালিকার উপরের দিকে থাকার যোগ্য দাবঘদার পেরুর হুয়াকাচিনা। মরুভূমি প্রেমী না হলেও সমস্যা নেই, এই স্থানটির অপার্থিব সৌন্দর্য্য আপনাকে বিমোহিত করবেই। একটি কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।



হুয়াকাচিনা হচ্ছে পেরুর উপকূলীয় সেচুয়া মরুভূমির মাঝখানে অবস্থিত একটি গ্ৰাম। সেখানে অনায়াসে কয়েকদিন কাটিয়ে দিতে পারবেন আপনি। এই গ্ৰামে মাত্র ১৫০ জনের কম সংখ্যক অধিবাসী বসবাস করেন, যাদের প্রায় সবই পর্যটন ব্যবসাতে কোনো না কোনো ভাবে জড়িত। মরুভূমির মাঝখানে হলেও আবাসন নিয়ে কোনও চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। কারণ পর্যটকদের থাকার জন্য চমৎকার কিছু হোটেল ও রেস্তোরাঁ আছে সেখানে। তবে মরুভূমিতে অবস্থানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল জল। আর হুয়াকাচিনা গড়ে উঠেছে মূলত একটি ছোট প্রাকৃতিক জলধারাকে কেন্দ্র করে। তাই এখানে জলজনিত কোনও সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না আপনাকে। আপনি চাইলে এখানে অবস্থিত জলধারাতে সাঁতার কাটতে পারবেন কিংবা নৌকা নিয়ে বেরতে পারবেন। 



সেচুয়া মরুভূমির তপ্ত বালু পথ পাড়ি করে দিয়ে আসার পর যখন বিভিন্ন গাছের ছায়া ঘেরা এই লেগুনা চোখের সামনে দৃশ্যমান হবে, তখন নিশ্চিত ভাবে আপনি এই সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে যাবেন। আসলে সেই ছোট লেগুনাই হুয়াকাচিনা গ্ৰামের প্রান। এটি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ। 


হুয়াকাচিনা যেতে হলে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে পা রাখতে হবে আপনাকে। এরপর পেরুর রাজধানী লীমা থেকে ইকা অঞ্চলে যেতে হবে বাস-যোগে। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে ইকায় বিমান বন্দর না থাকায় স্থলপথই একমাত্র ভরসা। রাজধানী লীমা থেকে বাসের মাধ্যমে ইকায় পৌঁছতে আপনার ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগবে। খুব বেশী সময় নয়, ইকা থেকে হুয়াকাচিনা মাত্র ৪ কিলোমিটারের পথ। বাসে করে যেতে সর্বোচ্চ ১০ মিনিট সময় লাগবে। স্থানীয় বাস সার্ভিসের সাথে আগে থেকেই অনলাইনে যোগাযোগ করে রাখলে ঝামেলা কম হবে। 



লীমা থেকে একেবারে হুয়াকাচিনা পৌঁছতে সব মোট ৪০ পেরুভিয়ান সোল (পেরুর মুদ্রার নাম) খরচ হতে পারে। হুয়াকাচিনা গ্ৰামে উন্নত মানের হোটেল ও রেস্তোরাঁ রয়েছে, যেখানে অনায়াসেই ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় খাবারগুলো পেয়ে যাবেন। তাই খাবার নিয়েও কোনও সমস্যায় পড়তে হবে না আপনাকে। 


কীভাবে মরুভূমির মাঝখানে এমন অনিন্দ্য সুন্দর জলধারা গড়ে উঠল! সেটা নিয়ে বিভিন্ন লোকশ্রুতি প্রচলিত আছে। হুয়াকাচিনা শব্দের অর্থ হচ্ছে ক্রোন্দনরত তরুণী। পেরুর বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, বহু বছর আগে একজন ইনকা রাজকন্যা মরুভূমির মাঝখানে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ঘটনাক্রমে সেই রাজকন্যা একজন শিকারীর হাতে ধরা পড়েন। শিকারী তার দিকে খারাপ নজরে তাকালে রাজকন্যা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে এবং তার হাতে থাকা আয়না মাটিতে পড়ে যায়। স্থানীয় লোকশ্রুতি অনুযায়ী আয়না মাটিতে পড়ে ভেঙে যায় এবং কাচের টুকরো থেকে পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় এই জলধারা। 


আবার অনেকের মতে এক ইনকা রাজকন্যা একজন সুদর্শন যুবককে প্রচণ্ড ভালোবাসতো কিন্তু পরবর্তীতে হঠাৎ করে সেই যুবক মারা যান। রাজকন্যা তার ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুতে এত বেশি কাঁদেন যে, তাঁর চোখের জল থেকে পরবর্তীতে সেই জলধারার সৃষ্টি হয়। এগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু জনশ্রুতি রয়েছে, সবগুলোতেই ইনকা রাজকন্যার কথা বলা হয়েছে। 


হুয়াকাচিনাতে চমৎকার সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত উপভোগ করতে পারবেন। বালির সাগর থেকে সূর্য উঠেছে কিংবা বালির সাগরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, দূর থেকে বালুকারাশি চকচক করতে শুরু করেছে।ষ, এসব দৃশ্য আপনার চোখে প্রশান্তি এনে দেবে। তবে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মতো বিষয়গুলি পরিপূর্ণ ভাবে উপভোগের জন্য কোনও বালির ঢিপির ওপর উঠতে হবে আপনাকে।


এছাড়া এখানকার প্রধান উপভোগ্য বিষয় হল স্যান্ড বোর্ডিং। হাওয়ার কারণে মরুভূমিতে বালু সরে গিয়ে কোনও কোনও স্থানে উঁচু ঢিপি তৈরি হয়। এই ঢিপিগুলোতে ওঠার পর কাঠ বা অন্যান্য কিছু দিয়ে তৈরি বোর্ডের মাধ্যমে নীচে নেমে আসা যায়। যদিও ব্যাপারটি স্নো-বোর্ডিং-এর মতোই। বরফাচ্ছাদিত অঞ্চলে স্নো-বোর্ডিং এর ক্ষেত্রে পায়ের নীচে যেমন স্নো বোর্ড থাকে, সেন্ড বোর্ডিং-এর ক্ষেত্রেও মরুভূমিতে আপনাদের পায়ের নীচে তেমন একটি স্যান্ড বোর্ড থাকবে।


এছাড়াও হুয়াকাচিনা গ্ৰামের আশে পাশের মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ডিউনি বালি গাড়ি রয়েছে। যেগুলোতে চড়ে চমৎকার রাইড উপভোগ করা যায়। 


মরুভূমির মাঝে এরকম একটি গ্ৰাম আসলেই আশ্চর্যের বিষয়। প্রকৃতি আমাদের সামনে এত সব অনিন্দ্য সুন্দর সৃষ্টি তৈরি করে রেখেছে যে, বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে পেরু বলতে আমাদের সামনে মাচুপিচু, নাচকালাইনস কিংবা রংধনু পাহাড়ের চিত্র ভেসে উঠলেও হুয়াকাচিনার কথা কখনই মনে আসে না। আস্ত মরুভূমির মাঝখানে জলে ভরা সমেত একটি গ্ৰাম, যেখানে স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেওয়ার পাশাপাশি চাইলে স্যান্ড বোর্ডিং বা বালি গাড়ির মাধ্যমে মরুভূমিতে চষে বেড়ানো। হুয়াকাচিনায় আসলে অনেক কিছুই আছে উপভোগের মতো।

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad