অনন্য রাজ্যপাল - press card news

Breaking

Post Top Ad

Post Top Ad

Tuesday, 1 August 2023

অনন্য রাজ্যপাল


 অনন্য রাজ্যপাল 



প্রেসকার্ড নিউজ ডেস্ক, ০১ আগস্ট: শোনা যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুশ ভেল্ট যখন হোয়াইট হাউজের সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা করতেন তখন তাঁর সামনে কোনও বেয়াড়া বা চাপড়াশি চলে এলে তিনি নাকি তাঁকে নাম ধরে উইস করতেন। এমনি অমায়িক ছিল তাঁর ব্যবহার। সচরাচর কোনও মানুষ এতটা উঁচুতে উঠে গেলে নিজেকে কেউকেটা-গোছের ভাবতে শুরু করেন। আপনারাও নিশ্চয়ই এমন অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু এরই একটা আশ্চর্য ব্যতিক্রম ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় রাজ্যপাল, যাঁর নাম ছিল হরেন্দ্র কুমার মুখার্জী। আজকের এই প্রতিবেদন তাঁকে নিয়েই। উল্লেখ্য, ১৯৫১ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৫৬ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত তিনি রাজ্যপাল ছিলেন। 

 

সেবারে কলকাতায় খুব জাঁকিয়ে শীত পড়েছিল। রাজ ভবনের লিফটম্যান অশোক রাউত ছিলেন উড়িষ্যার লোক। এমন হাড় কাঁপানো শীতে মোটেই অভ্যস্ত নন তিনি। এদিকে গায়ে অশোক স্তম্ভ বসানো ফুলহাতা ইউনিফর্ম পরে সারা রাত ডিউটি করতে হবে তাকে। তাতে কিছুতেই শীত মানে না। কিন্তু চাকরি বলে কথা! কোনও উপায় আছে কি! তাই সারারাত ওই ভাবেই কেটে গেল লিফট ম্যানের। তখন রাতের অন্ধকার কেটে সবে মাত্র ভোর হয়েছে, এমন সময় রাজ্যপাল হরেন্দ্র কুমার এডিসি ছাড়াই লাঠি হাতে প্রাতঃভ্রমণে বেরোলেন। কিন্তু দেখলেন লিফটের পাশেই ঠান্ডা শ্বেত পাথরের মেঝের ওপর কে যেন কুঁকড়ি মেরে ঘুমিয়ে আছে। "ও এটা তো লিফট ম্যান অশোক রাউত।" হরেন্দ্র কুমার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজের ঘর থেকে একটা গরম শাল এনে আশোকের গায়ে দিয়ে তার ঘুম না ভাঙিয়ে দিব্য প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। 


প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে অশোক হুড়মুড়িয়ে উঠে দেখে তার গায়ে দামি শাল। রাজ্যপালও কখন জানি বেরিয়ে চলে গেছেন।সর্বনাশ! সে তো একেবারে হরেন্দ্র কুমারের পায়ে লুটিয়ে পড়ল। "ভুল হয়ে গেছে হুজুর ক্ষমা করবেন, শীতের রাতে যে কখন ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারিনি। এমনটা আর কখনও হবে না। এই নিন আপনার শাল ফেরত নিন।" রাজ্যপাল হাসতে হাসতে বললেন, "আরে তুমি এত বিচলিত হচ্ছে কেন? তুমি আমি একই ভাই, ধরে নাও না আমি বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইকে উপহার দিয়েছি, ওটা তুমি রাখো।" রাজ্যপালের এমন ব্যবহারে শুধু লিফট ম্যান অশোক রাউত নয়, রাজভবনের সব কর্মচারীই মুগ্ধ ছিল। 


তবে সবার ব্যবহার তো এক রকমের হয় না, এই যেমন ধরুন রাজ ভবনের একটা বাবু ছিলেন মিস্টার দে চট্টগ্রামের মানুষ, তবে খুবই বদমেজাজি। একদিন তিনি রাজ্যপাল হরেন্দ্র কুমারকে একটা দরখাস্ত পাঠালেন, তার কোয়ার্টারের নীচে নাকি কিছু ঝাড়ুদার থাকে। সন্ধ্যের পর থেকে সকলে মিলে তারা ভজন গাইতে শুরু করে। সেই গানের গুঁতোয় তার ছেলে মেয়ের পড়াশোনা তো বটেই, এমনকি রাতের ঘুমের পর্যন্ত ব্যাঘাত ঘটছে। তাদের কে বললে দু-একদিন তারা গান বন্ধ রাখে বটে কিন্তু কিছু দিন পরেই যে-কে সেই, মহা মুশকিল! অনেক বার ওপরওয়ালাদের জানিয়েও কোনও লাভ হয় নি, তাই শেষমেষ রাজ্যপালের কাছেই দরখাস্ত করেছেন তিনি। 


এমন দরখাস্ত পেয়ে রাজ্যপাল ডেকে পাঠালেন মিস্টার দে কে বললেন, "আচ্ছা আপনি যেন কোন কোয়ার্টারে থাকেন?" উত্তর এল, "আজ্ঞে ৯ নম্বর গভর্নমেন্ট প্লেস নর্থ- এর কোয়ার্টারে। "হুম, দেখুন দে মশাই আমি ওদের হুকুম দিয়ে এখুনি গান বন্ধ করে দিতে পারি কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হবে বরং তাতে উল্টো ফল হতে পারে। এখন ওরা কাজের শেষে সন্ধ্যে বেলায় ভজন গায় কিন্তু সেটা বন্ধ করে দিলে ওরা সকলে মিলে মদ খেয়ে মাতলামি করতে পারে। এমন কি উপরে আপনাদের তলায় গিয়ে ঝামেলাও করতে পারে। সেটা কি ভালো হবে? তাছাড়া আপনার মতো অনেকেই তো সেই ব্লকে থাকেন, কই তারা তো কখনও এমন অভিযোগ করেননি। তাই বলছিলাম ওই গরীব বেচারাদের গান বন্ধ করে লাভ কি! আপনাকে বরং অন্য কোয়ার্টারের বন্দোবস্ত করে দিতে পারি।"


রাজ্যপালের মুখে এমন কথা শুনে মিস্টার দে আর বিশেষ বাক্য ব্যয় আর করেন নি। কিন্তু ওই দিকে ঝাড়ুদার সর্দার সন্ত কৃপালকে রাজ্যপাল ডেকে পাঠালেন, হুকুম দিলেন, "তোমরা যখন সন্ধ্যেবেলা গান বাজনা করবে, তখন ব্যারাকের জানলা-দরজাগুলো বন্ধ করে রেখো, যাতে বাইরে আওয়াজ কম যায় কেমন।"


এমনই আর একটা ঘটনা জেনে নেওয়া যাক- সময়টা ১৯৫৩ সালের নভেম্বর মাস। রাজ্যপাল হরেন্দ্র কুমার ব্যারাকপুরের ফ্লাগ স্টাফ হাউসে গিয়েছিলেন। সাথে রয়েছেন এ ডি ক্যাটান এস ব্যান্যার্জী আর সিকিউরিটি ইনস্পেকটর তিনকড়ি মুখার্জী। একদিন সকালে রাজ্যপাল কাউকে কিছু না বলে লাঠি হাতে পাশের পুলিশ টিবি হসপিটালে হাজির হলেন। সঙ্গে কোনও সিকিউরিটি অফিসার কেউই নেই। তাই তাঁকে তো কেউ চিনতেই পারলেন না। এদিকে হাসপাতালের অবস্থা দেখে রাজ্যপাল তো বেজায় রেগে গেলেন। জলের কুঁজো মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে, নার্স, আয়া কেউ কোথাও নেই। রোগীরা ছেঁড়া বিছানায় শুয়ে আছে; তাদের না আছে মশারি, না আছে কিছু। 


পুলিশের আইজি হরিসাধন ঘোষ চৌধুরীকে রাজ্যপাল অভিযোগ করলেন। হাসপাতালের এ কেমন অবস্থা! আমি টিবি ফান্ডের জন্য সব ব্যবসায়ী সাহেব সহেবে্দের কাছে ভিক্ষা চাইছি আর হাসপাতালের রোগীদের খাওয়ার জলের কুঁজোটা পর্যন্ত মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।" খুবই সত্যি কথা এই টিবি ফান্ডের জন্য রাজ্যপাল 'স্টার অফ ইন্ডিয়া' নামের শো পর্যন্ত করেছিলেন, যেখানে লতা মঙ্গেশকর, বাড়েগুলাম আলি, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেনদের মতো দিকপালরা গান বাজনা করেছিলেন। সেই শো থেকে টিবি ফান্ডের টাকা উঠল বটে কিন্তু রাজ্যপাল গান-বাজনার আসর বসিয়েছেন বলে কলকাতার খবরের কাগজে খুব সমালোচনাও হল। 


এরই মধ্যে হরেন্দ্র কুমার রাজভবনের সব কর্মচারীদের একদিন ব্যানগেট হলে চায়ের নেমন্তন্নে ডাকলেন। কিন্তু রাজভবনের কর্মচারীরা মনে মনে ভাবল এই হল গিয়ে মুশকিল! রাজ্যপাল এখন যেখানেই যান, সেখানে টিবি ফান্ডের টাকা তোলেন। 'স্টার অফ ইন্ডিয়া' শো করেছেন, ব্যারাকপুরে জুট মিলের মালিককে চা খাইয়ে তাদের থেকে ডোনেশন নিয়েছেন। এবারে বোধ হয় রাজভবনের কর্মচারীরাও বাদ পড়বে না। তাদেরও চা খাইয়ে ডোনেশন দিতে বলবেন। কিন্তু গর্ভনরের ডাকে কি আর সাড়া না দিলে চলে! অগত্যা যেতেই হল সেখানে। 


কিন্তু যেতেই রাজ্যপাল বললেন, 'আপনারা রাজভবনের কর্মচারী আর আমি আপনাদের গরীব রাজ্যপাল। আমার টিবি ফান্ডের হিসেব দেখে দিতে আমি আপনাদের একবারেই আদেশ দিতে পারি না, তাও আমি আপনাদের অনুরোধ করতে চাই, যদি আপনারা মাঝে মাঝে অফিস ছুটির পর এই খাতাপত্রগুলি একটু দেখে দেন তাহলে আর এগুলো মেন্টেন করার জন্য আলাদা করে মাইনে দিয়ে আমায় লোক রাখতে হয় না। সেই টাকা দিয়ে আমি রোগীদের জন্য ওষুধ টষুধ কিনে দিতে পারি।' এহেন রাজ্যপালের মাইনে সেই সময় ছিল ৫,০০০ টাকা। তবে, তিনি তার মধ্যে নিজে নিতেন মাত্র ৫০০ টাকা। বাদ বাকি সব টাকা তিনি হয় দুঃস্থ, বিধবাদের বা শিক্ষাখাতে অথবা টিবি ফান্ডে দিতেন। 


যেমন রাজ্যপাল ঠিক তেমনই ছিলেন তার স্ত্রী বঙ্গবালা মুখার্জীও। সেই সময় রাজভবনে একটা অলিখিত নিয়ম ছিল। সেখানে সাধারণ বাবুদের ডাকা হত মিস্টার বোস, মিস্টার চ্যাটার্জি ও মিস্টার রায় বলে। আর অফিসারদের ডাকা হত সেক্সেটরি সাহেব, এসডি সাহেব আর এডিসি সাহেব বলে। ঠিক তেমনই তাদের স্ত্রীদের জন্য ছিল নির্দিষ্ট সম্বোধন। সাধারণ বাবুদের স্ত্রীদের ডাকা হত বৌদি বলে কিন্তু অফিসারের স্ত্রী কে বলা হত মেমসাহেব। কোনও বেয়াড়া বা চাপড়াশি ভুল বশত কোনও মেমসাহেবকে বৌদি বলে ডাকতো, তাহলে রীতিমত ধমক খেতে হত; 'আমি তোমাদের বড় বাবুর বউ নই বুঝলে! আমাকে মেমসাহেব বলে ডাকবে।' এমন অলিখিত নিয়ম অনুসারে সাধারণত রাজ্যপালের স্ত্রী কে ডাকা হত লেডি সাহেব বা ম্যাডাম বলে। 


কিন্তু রাজ্যপালের স্ত্রী বঙ্গবালা দেবী ছিলেন এর আশ্চর্য ব্যতিক্রম, তাঁকে সবাই ডাকত মা বলে। যেমন ডাক, তেমনই তার কার্যকলাপ। সবাইকে ডেকে ডেকে তারা কেমন আছে, জিজ্ঞেসা করতেন তিনি। কোনও মেকানিক বা মজদুর কাজ করতে এলে তাদের ডেকে মিষ্টি খাওয়াতেন তিনি। তাঁর জীবনযাপন এতটা সাধারণ ছিল যে রাজভবনে রাজ্যপালের নিজস্ব ধোপা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার স্বামী এবং নিজের জামাকাপড় নিজের হাতে কাঁচতেন। 


এ তো গেল রাজ্যপালের স্ত্রীর কথা রাজ্যপাল হরেন্দ্র কুমার মুখার্জী নিজে রিফু করা জামা পড়তেন। তাঁর এমন সাদাসিধে জীবন যাপনের চোটে সরকারের অনেক টাকা বাঁচিয়ে ফেলতেন তিনি। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল এই যে, রাজ্যপালের এমন রকম-সকমে দিল্লীর সব কর্তা ব্যক্তিরা বেশ অসন্তুষ্ট হলেন। অনেক ভিআইপি -রা নাকি কলকাতার রাজভবনে এসে সব রকম সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। এই সব অভিযোগ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু তো ক্ষেপলেন হরেন্দ্র কুমার মুখার্জীর ওপর। তাকে কলকাতা থেকে সরিয়ে বম্বে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন। 


সে কথা অবশ্য গেল হরেন্দ্র কুমারের কানে। সেই শুনে তিনি বললেন, 'তার চেয়ে ববং আমি রাজ্যপালের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে আমার এন্টালির বাড়িতে থাকব। আমি কলকাতার রাজভবনের রাজ্যপাল। আমি যদি এখানে এইভাবে থাকতে পারি তাহলে আমার অতিথিরাও এই ভাবে থাকতে পারবেন। তাছাড়া আমি তো বেশ ভালোভাবেই আছি। আমি শুধু এই রাজভবনকে ফাইভ স্টার হোটেল বানাতে দেব না। রাজভবনের এই সব দামি দামি পর্দা আর আসবাবপত্র দুই দিন অন্তর অন্তর বদলে এই গরীব দেশের অর্থ ধ্বংস করতে আমি কিছুতে দেবো্ না। তাতে যদি কেউ রাগ করেন আমি এক্ষুনি ইস্তফা দিতে রাজি।'


 তাঁর এই দৃঢ় মনোভাবের জন্যই হোক বা মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায় আর সাংসদ অতুল্য ঘোষের হস্তক্ষেপের জন্যই হোক হরেন্দ্র কুমার মুখার্জীর সেবারে কোনও বদলি হয়নি। ১৯৫৬ সালের আগস্ট মাসে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন আর সেই পর্যন্ত তিনি রাজ্যপালের ফান্ডে ৮ লক্ষ টাকা জমিয়েছিলেন। 


শোনা যায়, সেই টাকা নাকি পরবর্তী রাজ্যপাল শ্রীমতি পদ্মজা নাইডু রাজভবনের পর্দা আর আসবাবপত্রের পেছনে খরচ করেছিলেন। তাঁর নাকি কলকাতা রাজভবনের পুরোনো সব কিছুই নোংরা ময়লা মনে হত। সেই রাজ্যপাল হরেন্দ্র কুমার মুখার্জীর নাকি বারে বারে বলতেন, 'আমরা বাঙালিরা সব দিক থেকে সরে গেছি বা পিছিয়ে পড়েছি একথা কখনও মনে করবেন না। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। সেই হরেন্দ্র কুমার মুখার্জীকে আজ আমরা ক'জনই বা মনে রেখেছি!

No comments:

Post a Comment

Post Top Ad